টাঙ্গাইলে-১ আসনে ৩ বারের এমপি বনাম ৩ বারের মেয়র

হাওর বার্তা ডেস্কঃ টাঙ্গাইল-১ (মধুপুর-ধনবাড়ী) আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মন্ত্রিত্বও পেয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারে। ভদ্র ও সজ্জন মানুষ হিসেবে তিনি সুপরিচিত। নির্বাচনী এলাকায় উন্নয়নও করেছেন চোখে পড়ার মতো। এবার তার সামনে নবীন প্রতিদ্বন্দ্বি ‘সরকার শহীদ’ নামে সুপরিচিত শহিদুল ইসলাম সরকার। তিনি আগে কখনো সংসদ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি।

তবে মধুপুর পৌরসভার মেয়র ছিলেন তিনিবার। একজন তিনবারের সংসদ সদস্য, বয়সে প্রবীণ। আরেকজন তিনবারের মেয়র, বয়সে নবীন। এই আসনের ভোটাররা বলতে শুরু করেছেন এবার নবীন-প্রবীণের লড়াই বেশ জমে উঠতে পারে।

‘ভোলা কমান্ডার’ হিসেবে সুপরিচিত মুক্তিযোদ্ধা ড. আব্দুর রাজ্জাক ২০০১ সালে অষ্টম সংসদ নির্বাচনে প্রথম বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সরকারি চাকরি (উর্দ্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা) ছেড়ে দিয়ে তিনি নির্বাচনে অংশ নেন। এই নির্বাচনে বিএনপি’র প্রার্থী ছিলেন ফকির মাহবুব আনাম স্বপন। তবে তিনি তৃতীয় হয়েছিলেন। দ্বিতীয় হয়েছিলেন বিএনপি’র বিদ্রোহী প্রার্থী খন্দকার আব্দুল গফুর মন্টু।

অবশ্য স্বপন এবং মন্টু মিলে যে ভোট (৫৩৫০৯+৪০৯৭২ = ৯৪৪৮১) তার চেয়ে বেশি ভোট (৯৮৪১৩) পেয়েছিলেন ড আব্দুর রাজ্জাক। ওই নির্বাচনে টাঙ্গাইলের ৮টি আসনের মধ্যে মাত্র দুটি আসনে জয়লাভ করেছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। বাকি আসনটিতে (টাঙ্গাইল-৭ মির্জাপুর) জয়লাভ করেছিলেন একাব্বর হোসেন।

নির্বাচনে জয়লাভের পর ড. আব্দুর রাজ্জাক দলের কৃষি ও সমবায়বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পান। এখন তিনি দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য।

আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, মধুপুর ও ধনবাড়ী এলাকা আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। কারণ এর আগে ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে এই আসনে জয়লাভ করেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবুল হাসান চৌধুরী। ৭ম সংসদ (১৯৯৬) নির্বাচনে তিনি বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব ব্যারিস্টার আব্দুস সালাম তালুকদারকে পরাজিত করে বিজয়ী হন।

৯ম সংসদ (২০০৮) নির্বাচনে দ্বিতীয় বারের মতো নির্বাচিত হন ড. আব্দুর রাজ্জাক। বিএনপি’র প্রার্থী ছিলেন ফকির মাহবুব আনাম স্বপন। ভোটের ব্যবধান ছিল ৮২৫৬১। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তাকে খাদ্য এবং ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী করা হয়। সফল মন্ত্রী হিসেবে তার সুনাম রয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুযারি ১০ম সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

ড. আব্দুর রাজ্জাকের বাড়ি ধনবাড়ী উপজেলার মুশুদ্দি গ্রামে।

দলের নেতা-কর্মীরা জানায়, বাড়ি ধনবাড়ীতে হলেও দুই উপজেলাতেই তিনি সমান জনপ্রিয়। বিশেষ করে মধুপুরের আদিবাসীরা তার প্রচুর ভক্ত।

ধনবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মীর ফারুক আহমাদ ফরিদ বলেন, আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনা তথা নৌকা হলো উন্নয়ন-অগ্রগতি, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও শান্তির প্রতীক। আর ড. আব্দুর রাজ্জাক একজন উন্নয়নকামী সৎ ও ক্লিন ইমেজের মানুষ। তিনি এলাকায় শিক্ষা বিস্তারের জন্য আউশনারা কলেজ, মহিষমারা কলেজ, শোলাকুড়ি কলেজ ও মুশুদ্দি রেজিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠাসহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করেছেন। কলেজ ও বিদ্যালয়গুলোতে আধুনিক ভবন ও অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। উপজেলার এমন কোনো রাস্তা নেই যেটি তিনি পাকা করেন নাই। এছাড়া তিনি মধুপুরে একটি আধুনিক অডিটরিয়াম নির্মাণ, মধুপুরের কাকরাইদে ৭২ হাজার মেট্রিক টনের ধারণক্ষমতা সম্পন্ন সাইলো নির্মাণ করেছেন। ধনবাড়ীতে আধুনিক উপজেলা কমপ্লেক্স ভবন, ৫০ শয্যার হাসপাতাল, মডেল থানা ভবন, পশু হাসপাতাল, ফায়ার সর্ভিস ভবনসহ বিভিন্ন দপ্তরের আধুনিক ভবন নির্মাণ ও ধনবাড়ীতে শতভাগ বিদ্যুতায়ন করেছেন এবং মধুপুরের প্রতিটি ঘরে শতভাগ বিদ্যুতায়নের কাজ চলছে। মধুপুর হাসপাতাল ৫০ শয্যা থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত ও একটি নার্সিং ইনস্টিটিউট করেছেন। হাওদা বিলসহ মধুপুর-ধনবাড়ী দুই উপজেলায় নদী, খাল, বিলের উপর অসংখ্য ব্রিজ স্থাপন করে যোগাযোগ ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নয়ন করেছন। ফলে আগামী নির্বাচনেও তিনি জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত হবেন।

ধনবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পৌর মেয়র খন্দকার মঞ্জুরুল ইসলাম তপন বলেন, ড. আব্দুর রাজ্জাক একজন সাদা মনের মানুষ। এ এলাকার জনগণের শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য তিনি সবসময় সচেষ্ট। মধুপুর-ধনবাড়ীর উন্নয়নের রূপকার। পাহাড়ীয়া এলাকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগসহ মধুপুর ও ধনবাড়ীর সর্বক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। কাজেই তার কোন বিকল্প নেই। তার এ উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার্থেই এবার ধনবাড়ী ও মধুপুরের মানুষ নৌকায় ভোট দিয়ে বিপুল ভোটে ড. রাজ্জাককে বিজয়ী করবে ইন্শাল্লাহ।

বিএনপি এই আসনে দুজনকে মনোনয়ন ফরম দিয়েছে। আগের দুই নির্বাচনের প্রার্থী ফকির মাহবুব আনাম স্বপন ও সরকার শহীদকে দলের মনোনয়নের চিঠি দেয়া হয়েছে। সরকার শহীদ ছিলেন বিকল্প প্রার্থী। ঋণ খেলাপির কারণে স্বপন ফকিরের মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় সরকার শহীদই এখন মূলপ্রার্থী হতে যাচ্ছেন।

দলের নেতা-কর্মীরা জানান মনোনয়ন পাওয়ার জন্যই দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছিলেন। বিএনপির ‘পরীক্ষিত নেতা’ হিসাবে দলের তৃণমূলেও রয়েছে তার শক্ত অবস্থান। জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন কিছুই তাকে জাতীয়তাবাদী আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। রাজপথের লড়াকু সৈনিক এবার দলের মনোনয়ন পাওয়ায় আসনটি তারা ফিরে পাবে বলে প্রত্যাশা করছেন।

সরকার শহীদ মধুপুরের বিখ্যাত সরকার পরিবারের সন্তান। বাবা মরহুম ময়েজ উদ্দীন সরকার টানা চারবার মধুপুর উপজেলার আলোকদিয়া ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট (চেয়ারম্যান) ছিলেন। মুসলিম লীগের রাজনীতি করতেন। পরবর্তীতে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ‘জাগদল’ গঠন করলে তিনি তাতে যোগদান করেন। আজীবন জিয়াউর রহমান ও বিএনপির প্রতি ছিল তার অবিচল নিষ্ঠা।

রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে ওঠা সরকার শহীদ বাল্যকাল থেকেই ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। ১৯৮৯ সালে মধুপুর কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হন। যশস্বী ফুটবলার হিসাবে তার খ্যাতি ছিল। এখনো ক্রীড়ামোদী হিসাবে অবদান রাখছেন। মধুপুর কলেজে স্নাতকে অধ্যয়নকালে ১৯৯৯ সালের নির্বাচনে তিনি প্রথম মধুপুর পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। পৌরসভার বর্তমান মেয়র এবং আওয়ামী লীগ নেতা মাসুদ পারভেজকে তিনি সে সময়ে বিপুল ভোটে পরাজিত করে জয়ের মালা গলায় পরেন।

এর পরবর্তীতে দুইদফা পৌরনির্বাচনে আওয়ামী লীগের দুই বিখ্যাত নেতা তার নিকট ধরাশায়ী হন। ২০০৪ সালের পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতা এবং মধুপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর মন্টুকে তিনি পরাজিত করেন।

একইভাবে ২০১১ সালের পৌর নির্বাচনে হারিয়ে দেন বর্তমান মধুপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং উপজেলা আওয়ামী লীগ সম্পাদক সরোয়ার আলম খান আবুকে। হেভিওয়েট আওয়ামী লীগ নেতাদের টানা তিন বার পরাজয়ের মাধ্যমে হেট্রিক করায় তিনি দেশব্যাপী আলোচনায় আসেন।

সরকার শহীদ প্রথমে মধুপুর উপজেলা বিএনপির যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন। পরে দুই দুইবার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি জেলা বিএনপি’র ক্রীড়া সম্পাদক এবং দেশনেত্রী সাংস্কৃতিক জোটের কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব। তিনি মধুপুর রিকশাশ্রমিক ইউনিয়ন, কুলিমজদুর ইউনিয়ন এবং ইটভাটা শ্রমিক সমিতির সভাপতি, ট্রাক মালিক সমিতি, শিল্প ও বণিক সমিতির উপদেষ্টা। এছাড়াও তিনি অসংখ্য স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত।

মধুপুর উপজেলা বিএনপি কার্যালয় তারই মার্কেটে অবস্থিত। টানা দুই দশক ধরে বিনা ভাড়ায় তিনি দলকে এটি ব্যবহার করতে দিচ্ছেন। তাকে নিয়ে মধুপুর ও ধনবাড়ী উপজেলার বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে কোনো মতবিরোধ নেই বলে জানান স্থানীয় নেতা-কর্মীরা।

এখন নেতা-কর্মীদের নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনী মাঠে নামলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাককে মোকাবেলা করা যাবে বলে বিএনপির তৃণমূল নেতা-কর্মীরা মনে করেন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর